মশা কি করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে?
2020-04-27
Covid-19 বা করোনাভাইরাসের প্রকোপে পুরো পৃথিবী এখন বিপর্যস্ত। ডাক্তার, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এমন মহামারী গত শতবছরেও দেখেনি মানবসভ্যতা। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। কারণ, শুধু করোনা নয় মশাবাহিত বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগেও প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায়। এছাড়া লাখ লাখ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে মশার কামড়ে। বাংলাদেশে সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ার ভয় তো আছেই, আছে ডেঙ্গুরও ভয়।
এই অবস্থায় মশার মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাস ছড়ায় কি-না, এখন জনমনে ভর করেছে করোনাভীতি। এই আতঙ্কের সঙ্গে ভাইরাসটি নিয়ে নানা বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। তারমধ্যে একটি, মশা কি করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে?
সহজ উত্তর; না, পারে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মশার মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাস ছড়ানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত করা গেলেও মশার মাধ্যমে এটি ছড়ায় না। অন্তত এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে এমন কোনো তথ্য বা প্রমাণ নেই যে মশা করোনাভাইরাস (SERS-CoV-02, MERS-CoV কিংবা মহামারি n-CoV-2019) ছড়াতে পারে।
আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, মশা অন্যান্য অনেক ধরনের ভাইরাস, যেমন-
– ম্যালেরিয়া,
– ডেঙ্গু, (সেরোটাইপ ৪টি)
– চিকুনগুনিয়া,
– পীতজ্বর,
– জিকা,
– রোজ রিভার ভাইরাস,
– ওয়েস্ট নাইল ফিভার,
– জাপানিজ এনকেফালাইটিস ইত্যাদি রোগ ছড়াতে পারলে কেন করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে না? কেন এইডস ছড়ায় না? তবে সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে কারও শারীরিক সম্পর্কের কারণেও অন্য ব্যক্তির দেহে জিকা বা এইডস ভাইরাস ছড়ায়, এটা সত্যি।
বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের মতো করোনাভাইরাসও মানুষের রক্তে উপস্থিত থাকতে পারে।
মানুষের রক্ত শোষণ করে স্ত্রী মশারা। আর আক্রান্ত মশার কামড়ের ফলে মানুষের শরীরে ভাইরাস ঢুকে পড়ে। এজন্য অবশ্য একটি ধাপের প্রয়োজন; তা হলো- ওই মশা প্রথমে আক্রান্ত কোনো প্রাণীকে কামড়াতে হয়, তারপর কোনো মানুষকে কামড় দিলে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন। যেহেতু রক্ত শোষণের মাধ্যমেই মশা এক আক্রান্ত মানুষ থেকে অন্য মানুষের দেহে বসে, তাহলে সেভাবে করোনাভাইরাসও ছড়ানোর কথা। অথচ ছড়ায় না। এখন প্রশ্ন হলো—রক্তের মাধ্যমে যেহেতু ম্যালেরিয়া ছড়ায়, ডেঙ্গু ছড়ায় আর মশা যেহেতু একজনের গায়ের রক্ত চুষে পরক্ষণেই আরেকজনের গায়ে হুল ফোটায়, তাহলে কি তার করোনা সংক্রমণের ভয় থাকে না?
আসলে সব ভাইরাসই মশা-মাছি বা কীটপতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায় না, ছড়াতে পারে না। একইভাবে এইচআইভি, ইবোলা ইত্যাদি ভাইরাস মানুষের রক্তে থাকলেও মশা তা ছড়াতে পারে না। করোনাভাইরাস এদের মধ্যে অন্যতম। করোনাভাইরাস মানুষের রক্তে থাকলেও মশা তা ছড়াতে পারে না। যদিও এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। করোনা ভাইরাসের বাহক হল মানুষ। মানুষের সংস্পর্শেই সংক্রমিত হয় এই করোনা ভাইরাস । দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটি নিশ্চিত করলেন গবেষকরা। করোনা হল একটা কমন রেসপিরেটরি ভাইরাস ইনফেকশন।
আর মশার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা না থাকার কারণ মূলতঃ দুটি। প্রথমত, মশার রক্তে যেমন ম্যালেরিয়া, জিকা, ওয়েস্ট নাইল ফিভারের জীবাণু বিকশিত (জীবনচক্র সম্পন্ন করা) হতে পারে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে তা হয় না। যে কোন ভাইরাসই জীবন্ত প্রাণিকোষ (Living Body) ছাড়া বাঁচতে পারে না। যেহেতু মশার শরীরে এই ভাইরাস বাসা বাঁধতে বা জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে না, তাই মশা করোনার বাহক হওয়ার যোগ্য নয়। তারপরও প্রশ্ন ওঠে, আক্রান্ত রোগীর দেহের রক্ত মশার হুলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক আরেকজনের দেহে কি প্রবেশ করতে পারে না? মশার হুলের মাধ্যমেও একই আশঙ্কা থাকবে না কেন?
আসলে মশারা নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে (ডিম উৎপাদন ও বংশবৃদ্ধি) মানুষ বা অন্য প্রাণীর রক্ত শোষণ করে থাকে। কিছু ভাইরাস, যেমন ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে মশার মাধ্যমে এক পোষক থেকে অন্য পোষকে নিজেদের ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণ ঘটায়।
এ বিষয়ে মহামারি বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় দেখা গেছে নতুন এই করোনাভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভাইরাস। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় তাদের শ্বাসতন্ত্র থেকে নির্গত ড্রপলেট বা লালার বিন্দু বা নাক ঝাড়ার সময় নির্গত জলকণার মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমিত কোন তল বা কোন কিছু স্পর্শের মাধ্যমে এটি ছড়ায়।
হু’-র মশা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অন্যতম কর্মকর্তা এরিক জ্যাকসন এই প্রসঙ্গে জানান, “কোনোও সংক্রমিত ব্যক্তিকে মশা কামড়ানোর পর, মশা নিজের দেহে তার #প্রতিলিপি তৈরি করতে পারেনা, এবং মশা এই ভাইরাসের বাহকও নয়। তাই মশার কামড়ে করোনা হয়না”।
এরই আলোকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসও মশার মাধ্যমে ছড়াতে পারে না। তাছাড়া কোভিড-১৯ কোনো ভেক্টর (মাধ্যম) বাহিত রোগ নয়। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত (Respiratory) প্রচণ্ড ছোঁয়াচে রোগ। তবে nCoV-2019 নামের এই করোনা ভাইরাসটি সর্ম্পকে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ, এটি এখনও নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া পরামর্শই অনুসরণ করা শ্রেয়। যেহেতু বিশ্বে করোনাভাইরাসটি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের নানা সংস্থার নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয়ের কাজটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই করছে, সেহেতু তাদের দেওয়া তথ্যের ওপরই নির্ভর করাটা মঙ্গলজনক। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। একই সঙ্গে সর্দি-জ্বর, হাঁচি-কাশি রয়েছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।